সংকট।পানির অভাবে  বিপন্ন জনপদ

0

বালি দিয়ে আবৃত চাষের জমি। বালি রোদে চিকচিক করছে। ওই বালুকাময় জমিতে সাধারণ চাষাবাদের সুযোগ নেই। তাই গারো পাহাড়ের পাদদেশে চাষিরা চাষের নতুন পথ খুঁজছেন। বস্তায় মাটি ও সার দিয়ে সবজি চাষের পথ খুঁজে পাওয়া গেলেও পানযোগ্য পানির সংকটের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি তারা।

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় গিয়ে দেখা যায়, এ পদ্ধতিতে আদা, মরিচ, বেগুন, লাউ, শিম, চাল, কুমড়া, বরবটি, শসাসহ আরও কিছু সবজি চাষ হচ্ছে। তবে পানির অভাবে ফসল ফলানোর বিকল্প পরিকল্পনা মাঝে মধ্যে মাঠে মারা যাচ্ছে।

আ বেনুকা ম্রং: ২০২০ সালে, কলমাকান্দার চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের বেনুকা ম্রং প্রথমবারের মতো পাহাড়ের ঢাল থেকে সবজি রক্ষার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে বস্তায় সবজি চাষের উদ্যোগ নেন। তিনি তুলনার জন্য একই সময়ে সরাসরি মাটিতে সবজি চাষ করেন। তিনি ৫০টি খালি সিমেন্টের ব্যাগে আট জাতের মরিচ এবং বারোমাসি সাদা ও কালো বেগুন চাষ করেন। সে বছরের বর্ষায় পাহাড়ি ঢালের পানি তার গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বস্তায় লাগানো মরিচ ও বেগুনে কোনো ক্ষতি না হলেও মাটিতে লাগানো সবজির চারা মরে যায়। এরপর তিনি মাটিতে সবজি চাষ থেকে দূরে সরে যান। তবে পানি সংকটের কারণে বস্তা পদ্ধতিতে চাষাবাদও বেকায়দায় পড়ছে। এ বছর তিনি লাউ, ডাঁটা, লাল শাক, পালংশাক, সরিষা, বাথুয়াশাক, বারোমাসি মরিচ ও বেগুনের বীজ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করছেন। নিজে চাষ করার পাশাপাশি আরও ১৬ জনের হাতে বিভিন্ন সবজির বীজ তুলে দেন।

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক) চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের এই কৃষকদের চাষের বিকল্প অনুসন্ধানে সহায়তা করছে। বারসিকের নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন বলেন, আমরাও পানীয় জল দেওয়ার চেষ্টা করছি। এগুলো এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

গভীর পানির সংকট: গারো ও খাসিয়া পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানীয় জলের সংকট তীব্রতর হচ্ছে। ওই দুই পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীভাঙা হাওরাঞ্চলের মানুষও একই বিপদে পড়েছেন। নদী-নালার কাছাকাছি গ্রামে কোথাও কূপ খনন করে পানি পাওয়া গেলেও জলাধার থেকে একটু দূরে মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। খাবার পানি সংগ্রহ করতে তাদের এক থেকে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। পানীয় জলের অভাবে গারো পাহাড়ের পাদদেশের অনেক গ্রাম বিলুপ্তির পথে।

কলমাকান্দার লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের চেংনী গ্রামের সোহেল মরি বলেন, পানির অভাবে একদিন এলাকা ছাড়তে হতে পারে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের চুনিয়া থেকে দেড় যুগ আগে চেংনীতে আসেন সোহেল। মাতৃতান্ত্রিক মান্দি (গারো) সমাজে বিয়ের পর ছেলেরা সাধারণত শাশুড়ির বাড়িতে যায়। বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ বাড়িটি সোহেলের। দূরে গারো পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়া তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে। এক সময় ছড়া থেকে গোসল, কাপড় ধোয়া ও খাবার পানি সংগ্রহ করা হতো। মাছও অনেকটা একই রকম। এখন নানা রাসায়নিক মিশ্রিত ঘোলা পানির ছড়া আসে।

একই চিত্র দেখা গেছে কলমাকান্দার পাতলাবন গ্রামে। একজন মহিলা মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট গভীর গর্ত থেকে জল তুলছিলেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনেক গর্ত খুঁড়ে তাতে পানযোগ্য পানি পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ গর্তে দুর্গন্ধযুক্ত পানি, অনেক বেশি আয়রন।

নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা; ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া; জামালপুরের নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও বকশীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে। খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের হাওর এলাকা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুরেও সংকট রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের মুখে পড়তে হয় গ্রামবাসীকে। বন্যার পানির সঙ্গে আসা বালু, পাথর ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থে শাক-সবজি ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বালিতে হাওরের উচ্চতা বাড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *