ভাঙা পা সাড়াতে এসে প্রাণ গেল শিশু আতিকার
সাত বছর বয়সী আতিকার দোলনা থেকে পড়ে ডান উরুর হাড় ভেঙে যায়। স্থানীয়ভাবে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও সুস্থ হননি। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) আনা হয়।
দালালরা তার স্বজনদের ভুলিয়ে শ্যামলীর মক্কা মদিনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে অস্ত্রোপচারও করা হয়। কিন্তু এরপর আর জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। এক পর্যায়ে বুধবার সকালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
চিকিৎসক ও নার্সসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।
এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অনিয়মসহ নানা অনিয়মের দায়ে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেন।
হাসপাতালের মালিক নুর নবীকে এক বছর এবং আনোয়ার হোসেন ও আবদুর রশিদকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে এ বছর হাসপাতালটি আবার চালু হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, শিশুটির বাবা আজিম বাদী হয়ে হাসপাতালের মালিকসহ আটজনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেছেন। ইতিমধ্যেই তিন অভিযুক্ত চিকিৎসক ও এক নার্সকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে হাসপাতালটি বৈধভাবে চলছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেআইনি হলে তাদের কার্যক্রম বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আতিকা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের আজিম ও শিলা দম্পতির মেয়ে। রমজানের প্রথম দিনে তিনি দোলনা থেকে পড়ে আহত হন। মঙ্গলবার শিশুটির মা ও দাদা তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
সেখানে এক্স-রে করার পর চিকিৎসক জানান, ভাঙা পায়ে প্লাস্টার করতে হবে। তবে দেরি হয়ে যাওয়ায় পা স্বাভাবিক হবে না।
এ কথা শুনে স্বজনরা কী করবেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। শাহজাহান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়
তিনি বলেন, মক্কা মদিনা হাসপাতাল, ২১/১৪, বাবর রোড, বি-ব্লক, শ্যামলীতে কম খরচে পা ভাঙার ভালো চিকিৎসা করানো হয়। তার কথায় শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে যান তার মা ও দাদা।
সেখানকার হাসপাতালের লোকজন জানান, দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে খরচ হবে ৩২ হাজার টাকা। এছাড়া সব ওষুধ কিনতে হয়।
এ অবস্থায় শিশুটির দাদা মো. সিরাজ জানান, ওই পরিমাণ টাকা তার কাছে নেই। তখন তারা বলে, যা আছে তাই দাও, তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। বাকিটা পরে পরিশোধ করবেন।
এরপর ডাঃ এ কে এম নিজামুল ইসলাম, ডাঃ দেওয়ান মোঃ আনিসুর রহমানের সহায়তায় (অ্যানেস্থেসিয়া) মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন।
পরে শিশুটিকে অক্সিজেন ছাড়াই হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পুরুষদের ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে দায়িত্বে ছিলেন ড. মোস্তাকিম বিল্লাহ ও নার্স মুক্তা ভৌমিক।
বুধবার ভোর ৪টার দিকেও মেয়ের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় তার মায়ের কাছে সন্দেহ হয়। সে নার্সকে ডাকল। শিশুটির প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরপরই চিকিৎসককে ডাকতে যান নার্স মুক্তা।
এ পর্যায়ে ডাক্তার মোস্তাকিম গিয়ে তার মুখে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে তিনি আতিকাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শিশুটির বাবা আজিম বলেন, ঘটনার সময় আমি হাসপাতালে ছিলাম না। শ্বশুরের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে ছুটে আসি। সেখানে গিয়ে মেয়েটিকে মৃত অবস্থায় দেখতে পেয়ে ঘটনার বিবরণ শুনি। পরে লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারি এ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক ও নার্সদের সহায়তায় বেশি লাভের আশায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করে আসছে। তাদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় আমার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ বলেন, শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় চারজনকে আটক করা হয়েছে। অন্যান্য পলাতক আসামিদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামলায় গ্রেপ্তার চিকিৎসক ও নার্স ছাড়াও পলাতক চার আসামি হলেন- হাসপাতালের মালিক নুর নবী, আবুল হোসেন, নাসের ও দালাল শাহজাহান।