তিতাসে গ্রাহক ভোগান্তি বাড়ছে
দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তিতাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি প্রায় ২.৯ মিলিয়ন গ্রাহককে ১৩,৩৯১.৩২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু যেহেতু এই কোম্পানির পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রাহকদের বেশিরভাগ সমস্যা সমাধানের জন্য কোম্পানির উপর নির্ভরশীল, গ্রাহক হয়রানি সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। দিনের পর দিন পরিদর্শন করেও গ্রাহকরা আশানুরূপ সেবা নিশ্চিত করতে পারছেন না। গ্রাহকদের কাছ থেকে দ্রুত সেবা পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তিতাস নিয়ে সরকারের ভাবনা ও সংস্কার খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন গ্রাহক তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য এমডির সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চান। এ অবস্থা চলছে দিনের পর দিন। পেট্রোবাংলাসহ প্রতিষ্ঠানটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করেন, তিতাসকে অন্তত তিন ভাগে ভাগ করে সব দায়িত্ব হস্তান্তর করা জরুরি।
তা না হলে গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক জানান, ২০২০ সালে উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে তিতাসে তিনটি পৃথক কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা হয়নি। পরে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে তিনজন ডিএমডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে আবাসিক গ্রাহকদের সমস্যা সমাধানের এখতিয়ার তাদের নেই। যেকোন ফাইলই যেতে হয় এমডির কাছে এবং সবশেষে তিতাসের বোর্ডে।
ফলে কাঙ্খিত সেবা পেতে গ্রাহকদের দিন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া শিল্প কারখানার গ্যাস লোড বৃদ্ধি, স্থাপনা পুনর্গঠন, নতুন গ্যাস সংযোগ, পুনঃসংযোগে গ্রাহকদের সীমাহীন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় তাদের। তিনি বলেন, আগের চেয়ে তিতাসের কার্যক্রম বেড়েছে। ভবিষ্যতে এটি আরও সম্প্রসারিত করা হবে। এ জন্য তিনটি আলাদা কোম্পানি না করে তিনটি জোনে ভাগ করতে হবে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট জোনগুলোকে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।
তিতাস গ্যাসের কার্যক্রম বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকায় বিস্তৃত। মুন্সীগঞ্জ থেকে শেরপুর, এবং ভৈরব থেকে কেরানীগঞ্জ- এই কর্মকাণ্ড বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। সীমিত জনবলসহ নানা সংকটের কারণে আশানুরূপ গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে তিতাসের আওতাধীন এলাকায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এসব সংযোগই এখন তিতাসের মাথাব্যথার কারণ। গত এক দশক ধরে নিয়মিত অভিযান চালিয়েও অবৈধ সংযোগ কার্যত কমেনি।
চলতি বছরের এপ্রিলে জ্বালানি বিভাগে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় পেট্রোবাংলা। উদ্দেশ্য ছিল সিস্টেম লস কমানো, গ্যাসের চুরি ও অপচয় রোধ করা এবং সরবরাহ ও ভোক্তাদের ব্যবহারের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। গ্যাস সেক্টরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেও বড় ধরনের সংস্কার নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রচলিত পদ্ধতিতে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের অপচয়, সিস্টেম লস, অবৈধ ব্যবহারের জন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না। ফলস্বরূপ, পেট্রোবাংলা এমন সংস্কার করার চেষ্টা করছে, যার মাধ্যমে প্রতিটি এলাকায় গ্যাস সরবরাহ, ব্যবহার বা সিস্টেম লস-গেইন হিসাব করা যাবে। আবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বও নির্ধারণ করা যায়। আমরা জ্বালানি বিভাগে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কাজ চলছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে জ্বালানি খাত। আমি আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার যথাযথ সংস্কারের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তারাও একই পুরনো ধারায় চলছে। আমি আশা করেছিলাম, জ্বালানি উপদেষ্টা অন্তত এ খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে এর সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা দেখি না। তিনি বলেন, তিতাসকে যদি তিনটি কোম্পানিতে ভাগ করা না যায়, তাহলে অন্তত প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। গ্রাহকদের দ্রুত সেবা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তাছাড়া দেশের শিল্প কারখানার উন্নয়নই হতে হবে মূল লক্ষ্য।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, আমরা যত দ্রুত সম্ভব গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। যাইহোক, তিতাস একটি খুব বড় এলাকা, যেখানে প্রচুর গ্রাহক রয়েছে; ফলস্বরূপ, পদ্ধতিগত কারণে কিছু ক্ষেত্রে কিছু বিলম্ব হতে পারে। তিতাসকে তিন ভাগে ভাগ করার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সরকারের ব্যাপার।