তথ্য গোপন করে চাকরি নিয়ে কোটিপতি
তথ্য গোপন করে চাকরি পাওয়া: ৩৬ বছর বয়সী বিসিএস রাজস্ব কর্মকর্তা তানজিনা সাথী একজন কোটিপতি। এনআইডিতে তার স্থায়ী ঠিকানা বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। কিন্তু বিসিএস অফিসার হিসেবে চাকরি পেলে বরগুনা জেলায় স্থায়ী ঠিকানা দেখান। এটি স্পষ্টতই তথ্য গোপন করার সমতুল্য, যা তাকে বরখাস্ত করা ছাড়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু তাই নয়, ট্যাক্স অফিসার হিসেবে চাকরি পাওয়ার তিন বছর পর বাবা-মায়ের নামে একটি টিআইএন সার্টিফিকেট পান, যেখানে তাদের কোটি টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। যাইহোক, তার মা, একজন গৃহবধূ এবং তার বৃদ্ধ বাবা, যারা এত টাকার মালিক, তিন বছর আগেও ট্যাক্স রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত ছিল না।
এ ছাড়া একই বিসিএস ব্যাচের (পুলিশ) আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে তানজিনার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরে ওই কর্মকর্তার কাছে তিন কোটি টাকার বেশি পাওনা থাকায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন তানজিনা।
এখানেই শেষ নয়। তানজিনা থাকেন মালিবাগে। তার অফিস টাঙ্গাইলে। তার বিরুদ্ধে বরাবরই অফিস ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দিনের পর দিন ভোগান্তির পর সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তানজিনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
তিনি সময়মতো এই নোটিশের জবাব দেননি। এমন পরিস্থিতিতেও সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়েছেন তানজিনা সাথী। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তানজিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অবৈধভাবে কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যার তদন্ত পর্ব শুরু হয়েছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মো. তানজিনা সাথীর বাবার নাম মোঃ মোশাররফ হোসেন মল্লিক, মা- মুসা রানী বিলকিস। স্থায়ী ঠিকানা- গ্রাম- মধ্য নেমতি, পোস্ট- নেমতি, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। বাবা ও মায়ের এনআইডিতেও একই ঠিকানা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে তার নামের পাশে বরগুনা লেখা রয়েছে তার জেলা। এদিকে বিসিএসে যোগদানের আগে তিনি সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন। সেখানে তার স্থায়ী ঠিকানাও লেখা আছে বরিশাল। ৩৮তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া তার ভাই মাহফুজুর রহমানের স্থায়ী ঠিকানা বাকেরগঞ্জ দেখানো হয়েছে। তার ভাইবোনদের স্থায়ী ঠিকানার পার্থক্য বিস্ময়কর!
এদিকে চাকরির আবেদনে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করেছেন তিনি। তবে বিসিএস পরীক্ষার আবেদনপত্র পূরণের আগেই মো: শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মন্ত্রিপরিষদের তথ্য অনুযায়ী, বিয়ের তারিখ ছিল ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩। যৌতুক ছিল ১০ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের 36 তম বিসিএস পরীক্ষা-2015-এর আবেদনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- মিথ্যা তথ্য প্রদান এবং অসৎ উপায় অবলম্বনের জন্য শাস্তি: (1) যদি কোনো প্রার্থী জেনেশুনে আবেদনপত্রে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন বা প্রয়োজনীয় গোপন করেন তথ্য… উল্লিখিত পরীক্ষা সহ কমিশন কর্তৃক পরিচালিত পরবর্তী পরীক্ষার জন্য তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। (2) কিছু ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ফৌজদারি আইনের কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে এবং উল্লিখিত প্রার্থীকে চাকরিতে নিযুক্ত করার পরে এবং প্রমাণিত হওয়ার পরে যদি এই ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হয়, তাহলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা ছাড়াও, যেকোনো উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তথ্য গোপনের পাশাপাশি তানজিনার বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, ট্যাক্স অফিসার হিসেবে যোগদানের আগে তানজিনা ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন।
তার বেতন ছিল ২২-২৫ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী বছরে তার বেতন সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। ৭ বছরে কোনো টাকা খরচ না করলেও তার মোট আয় ১৭ লাখ টাকা।
তানজিনা সাথী তার আয়কর (২০২১-২২) ফাইলে তার স্থায়ী ঠিকানা হিসাবে বরিশাল লিখেছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে, তিনি তার নিট সম্পদ দেখিয়েছেন ২ কোটি ১৬ লাখ ১ হাজার ৫৯২ টাকা।
এর মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন ৪৬ লাখ টাকা। ৩৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। এছাড়া ৮৩টি স্বর্ণালঙ্কার দেখান তিনি। আগের বছরের ট্যাক্স ফাইলে তিনি আড়াই কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে যখন তিনি কর কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন, তখন তিনি তার বিবৃতিতে প্রায় ১.৫ কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়েছিলেন।
এই সম্পদ যদি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় তাহলে তানজিনার দুই ভাই ও তিন বোনেরও সমান সম্পদ পাওয়া উচিত। সে অনুযায়ী তার বাবা-মায়ের অন্তত ১০ কোটি টাকার সম্পদ থাকতে হবে। তবে মেয়ে তানজিনা ট্যাক্স অফিসে যোগদানের ৩ বছর পর ট্যাক্স ফাইল খোলেন তারা। এ সময় তার গৃহবধূ মা ও বৃদ্ধ বেকার বাবার প্রায় সাত কোটি টাকার সম্পদ ছিল বলে দেখা গেছে। এত সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও, তারা ২০২২ সালের আগে কর দেয়নি। তানজিনা আয়কর বিভাগে চাকরি নেওয়ার তিন বছর পর (২০২১-২২), তার বাবা-মায়ের নামে একটি ট্যাক্স ফাইল খোলা হয়েছিল। তারা বরিশালের বাসিন্দা হলেও ঢাকা কর অঞ্চল-৭ এর সার্কেল-১৫০ থেকে রানী বিলকিসের (মা) নামে ট্যাক্স ফাইলে মোট ৩ কোটি ১১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৪ টাকা দেখানো হয়েছে।