চট্টলার সাগরিকা থেকে পতেঙ্গা। সমতল থেকে ৩০ফুট উঁচু। এক কথায় চিত্তাকর্ষক। সহজে সাগরপাড়া পৌঁছানোর জন্য ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি জাদুকরী রাস্তা। পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। এর পরেও গাড়ি ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে চলে। দুই হাজার ৮৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কের বাঁকে মৃত্যু লেখা হয়েছে। কয়েকদিন পর পর রক্তে ভিজে কালো পিচ। ছুটির দিনে সাগরপাড়ে যেতে ওই সড়কে ভিড় থাকে। তবে পথচারীদের নিরাপত্তায় সড়কে নেই স্পিড বাম্প, ফুট ওভারব্রিজ, স্ট্রিট লাইট। সড়কটি নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কাগজে কলমে এটি চালু না হলেও, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে। তারপর থেকে শনিবার পর্যন্ত ৫০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গুও হয়েছেন। ফলে সড়কটি নিয়ে ভাবছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।

এ পরিপ্রেক্ষিতে অপরিকল্পিতভাবে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সড়ক নির্মাণে স্থানীয় ও পর্যটকদের যাতায়াতের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যে কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।

দেড় লাখ বাসিন্দা ও হাজার হাজার পর্যটকের যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই : সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, সাগরপাড়ের চারপাশে আটটি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এখানে বাস করে, যাদের কোন না কোন কারণে এই রাস্তা পার হতে হয়। সমুদ্র উপকূলে ৯ টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (মৎস্য ঘাট), তিনটি সংযোগ সড়ক, একাধিক চারণভূমি এবং মাছ ধরার মাঠ রয়েছে। তবে সড়কপথে পথচারীদের পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে স্থানীয়রা।

ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বিজয় জলদাস ট্রলারের যন্ত্রাংশ কাঁধে নিয়ে শহরের কাট্টলী রানী রাসমনি ঘাট দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “সড়কটি নির্মাণের পর থেকে  জেলে সম্প্রদায়ের লোকজনকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মাছ ধরার মৌসুমে মাছের ওজন কাঁধে নিয়ে এই উঁচু রাস্তা দিয়ে উঠতে হয়। তখন দ্রুতগামী গাড়ির ফাঁক গলে হাতে হাত রেখে কোনোমতে রাস্তা পার হতে হয়। সাগরে জাল বসানোর জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি একটি কার্টে করে নৌকায় নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ঠেলাগাড়ি নেওয়ার জায়গা ছিল না। রাস্তা পুরোপুরি উন্মুক্ত হলে ঘাটগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি? ‘

একের পর এক মৃত্যু: চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগে যানবাহন চালু হওয়ার পর থেকে সড়কে ৫০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে গত বছরের ১৬ নভেম্বর আউটার রিং রোডের ধুমপাড়া এলাকায় স্ত্রী মাহমুদা আক্তার ওরিন ও মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া আতিফাকে হারিয়ে কলেজ শিক্ষক নূর নবী পারভেজ রয়েছেন। বালুর ট্রাকের চাপায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর রাস্তা পার হওয়ার সময় কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় আট বছর বয়সী তুহিন। ২৪ জুন আউটার রিং রোডে পাথরবাহী ডাম্পারের ধাক্কায় লোটাস আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। হানিফ মারা গেছে।

যিহোবা নামের একজনকে হত্যা করা হয়েছিল। বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র সজিব উদ্দিন তৌহিদ ১০ এপ্রিল মারা যান। ৫ ফেব্রুয়ারি গাড়ি দুর্ঘটনায় ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত হন। চার বছরের মেয়েকে হারানো বাবা জসিম উদ্দিন, সমকালকে বলেন, আমি যখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম তখন কোনো গাড়ি ছিল না। চোখের পলকে পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল এসে আমার মেয়েকে ধাক্কা দেয়। এর কয়েকদিন পর একই স্থানে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে।

কে কী বলেন: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ শামসুল হক সমকালকে বলেন, “শুধু যান চলাচলকে প্রাধান্য দিয়ে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে। বিপুল স্থানীয় জনসংখ্যা বিবেচনা করে এটি পরিকল্পিত ছিল না। সড়কটির নির্মাণ পরিকল্পনায় ভুল ছিল। তাই গাড়ি ও মানুষ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। হতাহতের ঘটনা রয়েছে। দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য বিশ্বজুড়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে পর্যটক, মাছ ধরা সম্প্রদায়ের স্থানীয়রা তাদের প্রয়োজনে সমুদ্রে ভ্রমণ করতে পারে। কারণ সমুদ্রের সঙ্গে সমুদ্রতীরের মানুষ ও পশুপাখির জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে। এটা বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বলা যাবে না।

চট্টগ্রামের মৎস্য জরিপ কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সাগরপাড়ে পাঁচটি স্থায়ী ঘাট রয়েছে। চারটি অস্থায়ী ঘাট রয়েছে। যেগুলোতে ইলিশের মৌসুমে মাছ ধরার নৌকাগুলো ভিড় করে। নিবন্ধিত বন্দি রয়েছে ৪ হাজার ১০৫ জন। যারা সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। যানবাহনের অভাবে তারা ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিষয়টি ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

প্রকল্পের পরিচালক ও চকের প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস সমকালকে বলেন, ক্রসিংটি ছিল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *