দীপু মনির টাকার খনি ছিল মেঘনার বালু
ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কারাগারে গেলে সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ আদালতে যেতেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে যেদিন এই আদালতে তোলা হয় সেদিন দীপু মনিকেও আদালত এলাকায় দেখা গেছে। মূলত শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই তার সামনে মুখ দেখাতেন। এই চেহারা দেখে কপাল খুলে গেল দীপু মনির। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর তিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় স্থান পান। বাংলাদেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। এরপর চাঁদপুর জেলার নিয়ন্ত্রক হন ডা.দীপু মনি। জড়িয়ে পড়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে। গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। আসলে তিনি আখের গোছাতে চাঁদপুর আওয়ামী লীগকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করেন। এত কিছুর পরও গত ১৬ বছরে দীপু মনি সবসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে পেরেছেন।
দীপু মনি চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসন থেকে টানা চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি আওয়ামী লীগ সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর পাশাপাশি অনেক সিনিয়র নেতাও হারিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ঘন ঘন বিদেশ সফরের কারণে তিনি ‘ফ্লাইট মিনিস্টার’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তবে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তিনি আরও বেশি সমালোচিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে সাড়ে চার বছরে দীপু মনি ১৮৭ বার বিদেশ সফর করেছেন এবং ৬০০ দিন বিদেশে অবস্থান করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে ২০০৯ সালে সরকার যে লবিস্ট নিয়োগ করে তার দায়িত্ব নিজের স্বামীকে দেন তিনি। আর এই কাজের মাধ্যমে তিনি অনেক টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দীপু মনি আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলা লড়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে বিদেশি আইন সংস্থাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও দুর্নীতির আশ্রয় নেন। মোটা অংকের বেতন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চাঁদপুরের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করেছেন, দীপু মনি নিজের স্বার্থ বাঁচাতে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করেছেন। এর বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ একক রাজত্ব কায়েম করে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ দলের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই ছিলেন তার চক্ষুশূল। তিনি তাদের ছাড়া অগ্রহণযোগ্য নতুন নেতা ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দল চালাতেন। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দীর্ঘদিন ধরে দল ছেড়ে আসা দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও চাঁদপুরের সমগ্র জনগণের ওপর। এরপরও লাঞ্ছিত ও মামলার ভয়ে দীপু মনির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারেনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ৫ আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেলেও গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম বলেন, কোনো সংগঠন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক হওয়া কাম্য নয়। এর আগে এক ব্যক্তির কারণে জেলা নেতাদের মধ্যে অনৈক্য ছিল। সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে এটা আমি কখনো চাইনি, এখন চাইও না। কারণ যেকোনো অনৈক্য সংগঠনকে দুর্বল করে দেয়।
এদিকে দীপু মনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় চাঁদপুর সিটি ডিফেন্স ড্যাম, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ৬০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকার প্রতারণার সঙ্গে তার ভাই টিপুও জড়িত ছিল। তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠির পর এ লুটপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। যে কারণে সে সময় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েও শহর রক্ষায় স্থায়ী ও মজবুত বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ব্যর্থ হয়।
এ ছাড়া মেঘনার চরে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জাপানি অর্থায়ন নেওয়া হয়। তবে ছয় হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মেঘনায় দীপু মনির শত কোটি টাকার অবৈধ বালু ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি এবং তার ভাই জেআর ওয়াদুদ টিপু বিনিয়োগকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করেন।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক মো. মইনুল হাসান দোলন বলেন, আমি এই প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম। বিনিয়োগকারীরা প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে দীপু মনিকে একটি রূপরেখা দেন। তবে ওই রূপরেখায় প্রকল্প এলাকার ৬-৭ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ড্রেজিং বা বালু উত্তোলন করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে সেই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি।