কয়েক বছরে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট,বেক্সিমকোসহ কয়েকটি গ্রুপের পেটে রপ্তানি তহবিলের ঋণ
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সমন্বয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে। বিদায়ী সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ থেকে শুরু করে ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারিতে আলোচিত ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ ও এসবি পুণ্য গ্রুপ পর্যন্ত ঋণের নামে আত্মসাৎ করেছে ইডিএফ। আকিজ গ্রুপও সময়মতো ঋণ ফেরত দেয়নি। এগুলি ছাড়াও, আরও অনেক স্বনামধন্য সংস্থা রয়েছে, যারা ইডিএফ ঋণ গ্রহণ করেছে। আবার ডলার সংকটের কারণে যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে তাদের হিসাব থেকেও তা সমন্বয় করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ইডিএফ ঋণের একটি বড় অংশ বকেয়া ও খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই তহবিলের শীর্ষ ৪০ জন সুবিধাভোগীর ৬০ কোটি বা ৬০ কোটি ডলার দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। এর মধ্যে ঢাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের আওতাধীন ২০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫৬০ মিলিয়ন ডলার রয়েছে, যার বেশিরভাগই ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ এবং বেক্সিমকো গ্রুপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের আওতাধীন ২০ রপ্তানিকারকের কাছে রয়েছে প্রায় ৩ কোটি ডলার। ইডিএফ ঋণ সময়মতো ফেরত না পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারণ এই ঋণ ছাড়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স এবং ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানের পদত্যাগের কারণে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা সহজে এই ঋণের সুবিধাভোগী হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি তাদের ঋণ তদারকিতে সংশ্লিষ্টদের দমন করতেন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কাজী ছাইদুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ইডিএফের বকেয়া অনেক দিন ধরে। গ্রাহকদের মধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে তারা এসব ডলার ফেরত আনার সাহস দেখায়নি। আবার ব্যাংকগুলোতে ডলার না থাকায় তাদের হিসাব থেকে সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। এখন নতুন সরকার আসছে। তারা চাইলে চাপ দিলে এসব ঋণ আদায় করা যায়।
জানা যায়, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর ২০২০ সালের এপ্রিলে ইডিএফের আকার ৩.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। পর্যায়ক্রমে তা আরও বাড়িয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার করা হয়। যাইহোক, এপ্রিল ২০২২ থেকে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পরে, ইডিএফ ঋণ নিরুৎসাহিত করার জন্য সুদের হার বাড়ানো হয়েছিল। গত বছরের মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রবিধান জারি করে। মূলত আইএমএফের দেওয়া ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের শর্ত পূরণ করতে গত বছরের মাঝামাঝি এই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের তদবিরে তা আবার চালু করা হয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, তহবিলের অবস্থান ২.৬ বিলিয়নে নেমে এসেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মাজবাউল হকের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
লুটপাটে বিসমিল্লাহ ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ : ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এমএ কাদের ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের তিনটি প্রতিষ্ঠানই ইডিএফ ঋণের সুবিধাভোগী। জাল কাগজপত্র দিয়ে এসব ঋণ জালিয়াতির আড়ালে রপ্তানি না করে নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ইডিএফ ঋণ বকেয়া আছে। এই ঋণের সিংহভাগই নেওয়া হয়েছে জনতা ব্যাংক থেকে। এর মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যারের নামে ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার, ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টের নামে ৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার এবং রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যারের নামে ৫ কোটি ১৭ লাখ ডলার উত্তোলন করা হয়েছে।