পূর্বাভাস বিবেচনায় নেওয়া হয়নি
ভারি বর্ষণের কারণে উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি এলাকায় কিছু জায়গায় স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে – আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১ আগস্টের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। পূর্বাভাসে সঠিক অবস্থান, তারিখ এবং বৃষ্টিপাত উল্লেখ করা হয়নি। গত ৪ আগস্ট থেকে চট্টগ্রাম বিভাগে ভারি বর্ষণ শুরু হয়। তা সত্ত্বেও আবহাওয়া অধিদফতর তার নিয়মিত বুলেটিনে বৃষ্টির পরিমাণ অনুমান করতে পারেনি।
তা সত্ত্বেও আবহাওয়া অধিদফতরের দেওয়া সতর্কবার্তাকে আমলে নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। ভূমিধসের আশঙ্কার কথা বলা হলেও দুর্যোগ এড়াতে কোনো ব্যবস্থা নেই, প্রচারও হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কারোরই দুর্যোগ মোকাবেলায় কোনো আগাম প্রস্তুতি ছিল না। ফলে বৃষ্টি ও বন্যায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচটি জেলা বিলীন হয়েছে। বুধবার পানি নামার সঙ্গে ক্ষতের চিহ্ন বেরিয়ে আসছে। মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক, কাঁচা রাস্তা, কালভার্ট বন্যা ও প্লাবিত হওয়ায় ভেঙ্গে গেছে। নড়বড়ে হয়ে গেছে অনেক বাঁধ, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ভেসে গেছে বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের। এ পর্যন্ত ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া অধিদফতর পূর্বাভাসের মডেল ও তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ দুর্ভোগ ও বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে এ পর্যন্ত টানা ১১ দিন ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগের রেকর্ডগুলোর মধ্যে ২০০৭ সালে ৬১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসে ১২৮ জন মারা যায়। ২০১১ সালে টানা ছয় দিনের ভারী বৃষ্টিতে ১৯ জন মারা গিয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৭ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণের পর ভূমিধসে ১৬৯ জনের মৃত্যু হয়। প্রাণহানি হলেও বড় ধরনের দুর্যোগের সময় সঠিক পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবার, পূর্বাভাস পদ্ধতি পুরানো। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও ওয়েবসাইটটির আধুনিকায়ন হয়নি। অফিসিয়াল ফেসবুক পেজও নিয়মিত আপডেট হয় না। গত এক সপ্তাহের বৃষ্টির বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ফেসবুক পেজে কোনো তথ্য নেই। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগাম সতর্কতা দিতে পারেনি। এর আগে, বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়েও পূর্বাভাসে ঘাটতি, ভুল তথ্য এবং ওয়েবসাইট ডাউনটাইম মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছিল। আগাম সতর্কতার অভাবে মানুষ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আবহাওয়াবিদ্যার নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক জ্ঞান ছাড়া পূর্বাভাস মডেল ডেটার এক থেকে তিন সপ্তাহ বিশ্লেষণ করে সতর্কতা জারি করা কঠিন। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বর্তমান কর্মীর কারোরই আবহাওয়াবিদ্যায় একাডেমিক ডিগ্রি নেই। তারা সাধারণ বিষয়ে পড়াশোনা করছে এবং কিছু প্রশিক্ষণও করছে। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসে এলাকা-নির্দিষ্ট তথ্য থাকে না। ফলে স্থানীয় প্রশাসন পূর্বাভাস আমলে নিয়ে আগাম প্রস্তুতি নিতে পারছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল হাসানও মনে করেন, পূর্বাভাস দিতে না পারার প্রধান কারণ অধিদপ্তরের বিশ্লেষণী ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত দেশগুলোর আবহাওয়া সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে এ তথ্য পাওয়া যায়; এছাড়াও গুগল, ইয়াহুতে। কেন সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা ভুল হবে? প্রকৃতপক্ষে, সঠিক পূর্বাভাস শুধুমাত্র তথ্য সম্পর্কে নয়। এর জন্য পূর্ববর্তী ৩০ থেকে ৪০ বছরের আবহাওয়ার তথ্যের সাথে বর্তমান আবহাওয়ার তুলনা এবং এর সঠিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ডঃ আইনুন নিশাত বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাসের জন্য আঞ্চলিক মডেল ব্যবহার করে। তারা সমুদ্র এবং সমুদ্রবন্দর ভবিষ্যদ্বাণী করে। অর্থাৎ তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এছাড়াও, তারা যে সংকেত দেয় তা ত্রুটিপূর্ণ, যা সাধারণ মানুষের কাছে আসলে কিছুই বোঝায় না। বলা হচ্ছে, বরিশাল বিভাগে বৃষ্টি হবে। কিন্তু দু-এক জেলায় বৃষ্টি হলে অন্য জেলার মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে।
বড় শহরগুলো বৃষ্টি হলেই ডুবে যায়। তবে কেন বন্যা হচ্ছে, কী কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা জানার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে পাঠানো হলেও তারা আমলে নেয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আবহাওয়াবিদ জানান, জেলা পর্যায়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের অফিস থাকলেও তাদের ডাকা হয় না।