বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস আজ।
ঘূর্ণিঝড় ইলার বেদনাদায়ক স্মৃতি এখনো মুছে যায়নি উপকূলবাসীর মন থেকে। তারা কোনোভাবে সেই ধাক্কা সামলেছে। এরপর হানা দেয় ফণী। বুক খুলে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের বিপক্ষে বড় শট মারতে পারেনি ফণী। এখানে আসে আম্পান, এবার সুন্দরবনের উপকূল রক্ষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে ম্যানগ্রোভ প্রাচীর কতটা মজবুত, তাও বুলবুলের ঘা দেখিয়ে দিল। এভাবে ম্যানগ্রোভ বন অনেক বছর ধরে অনেক ঝড় সহ্য করেছে। যাইহোক, সুন্দরবন নিজেই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও মানবসৃষ্ট আঘাতের ঝুঁকিতে রয়েছে।
শুধু সুন্দরবন নয়, কুয়াকাটা, কক্সবাজার, নোয়াখালীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে ম্যানগ্রোভ বন উধাও হয়ে যাচ্ছে। কোথাও দখল, কোথাও চিংড়ি চাষ আবার কোথাও নদীভাঙন বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই শ্বাসরুদ্ধকর বন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। গত ২৭ বছরে বাংলাদেশ তার প্রাথমিক বনভূমির ১৯ শতাংশ হারিয়েছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যানগ্রোভ বা শ্বাস-প্রশ্বাসের বন দিবস। জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা বা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে ২৬ জুলাই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অত্যাবশ্যক বাস্তুতন্ত্রের টেকসই সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে সচেতনতা বাড়াতে ইউনেস্কো ২০১৫ সালে দিনটিকে বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট প্রাচীর অনেকাংশে ঝড়ের ঢেউ শুষে নিতে পারে। ফলে ম্যানগ্রোভ বন বাড়াতে হবে। তবুও থেমে নেই সবুজ-সবুজ ম্যানগ্রোভের হানা। ধীরে ধীরে অনেক বন উজাড় হচ্ছে। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। কিন্তু সেই ম্যানগ্রোভ বন হারিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অভাবে উপকূলীয় বনাঞ্চল ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভাঙনে ১৩ বছরে দুই হাজার একর বনাঞ্চল সাগরে বিলীন হয়েছে। ভেঙে পড়েছে দুই লাখের বেশি গাছ।
বিশ্বের ৪৮ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছের মধ্যে ১৯টি সুন্দরবনে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের প্রায় ৬২ শতাংশই বাংলাদেশে। বিশ্বের বেশিরভাগ ম্যানগ্রোভ বনে দুই থেকে তিন প্রজাতির টেপারুট রয়েছে। আর সুন্দরবনে রয়েছে ছয় ধরনের শ্বাসমূলের শিকড়, যা বনকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। ‘ইন সার্চ অব ডেভেলপমেন্ট’-এর গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনার কয়রা অঞ্চলে দুই দশকে (২০০০-২০২০) বনের ঘনত্ব প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯০৪-১৯২৪ সালে, বাংলাদেশ ও ভারতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১,৯০৪ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে। ২০০১ সালে আয়তন কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৪৫৩ বর্গকিলোমিটার। সব মিলিয়ে গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমেছে।
ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) এর একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালের হিসাবে, বিশ্বের ম্যানগ্রোভ বনের তিন-চতুর্থাংশ এশিয়ায় রয়েছে। এর ২৪ শতাংশ বাংলাদেশে। মিয়ানমারে ১৯ শতাংশ, ভারতে ১৭ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ১৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে ম্যানগ্রোভ বনের অবস্থা খুবই নাজুক। ১৯৯২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ম্যানগ্রোভ বনের আয়তন ১৯ শতাংশ কমেছে।