আজ থেকে শুরু হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ।মাছ উৎপাদনে এগিয়ে, রপ্তানিতে পিছিয়ে
‘মাৎস্য মারিবো খাইবো সুখে, কি আনন্দ লাগছে বুকে’ – বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ৯০ দশকের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটি এখনো অনেকের কানে বাজে। সে সময় শিক্ষিত যুবকরাও মাছ চাষের স্বপ্নে বিভোর হন। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ স্লোগান গত ৩৩ বছরে পাল্টেছে। মিঠা পানি ও চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
তবে মাছ উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এখন রপ্তানিতে অবস্থান ২১তম। এক যুগে মাছের উৎপাদন ৮৫ শতাংশ বাড়লেও দাম নাগালের বাইরে। রপ্তানি বাধা দূর করতে সরকার এখন নিরাপদ মাছ উৎপাদনের ওপর জোর দিচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ‘নিরাপদ মাছে দেশ মজুদ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগানে আজ সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ। নিরাপদ মাছ ধরার প্রসারে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মাছের উৎপাদন ছিল ৪৭.৫৯ মিলিয়ন টন, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের ২৫.৬৩ মিলিয়ন টন থেকে ৮৫.৬৮ শতাংশ বেশি। মাথাপিছু দৈনিক মাছের চাহিদা ৬০ গ্রাম থেকে বেড়ে ৬৭.৮০ গ্রাম হয়েছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলেও নিয়ন্ত্রণে নেই মাছের বাজার। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে খামারিরা বলছেন, মাছের খাবার, ওষুধ ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় সেচের পানি দিয়ে পুকুর ভরাট করতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের কাছে কম দামে মাছ বিক্রি করা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। আর চাষকৃত মাছে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।
শীর্ষ ১০টি রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশের মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া এসব দেশের মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার মধ্যেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ লাখ ৮৮ হাজার টন মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা।
এদিকে দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা থাকলেও দেশের কোনো কোম্পানি সেভাবে প্রক্রিয়াজাত মাছের খাবার তৈরি করছে না। মাছের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি হলেও শুধুমাত্র চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে এবং তাও শুধুমাত্র রপ্তানির জন্য।
হিমায়িত খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্যারাগন এগ্রো ফুড লিমিটেডের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, হিমায়িত পণ্যের বেশির ভাগই মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি। আমরা দুই-তিনটি মাছের খাবার করছি, তবে তা ব্যয়বহুল। যার কারণে ইচ্ছামতো অনেক পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, রপ্তানির জন্য সঠিক উপায়ে নিরাপদ মাছ উৎপাদন করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, মৎস্য অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। রপ্তানি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, রপ্তানিযোগ্য মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার চিংড়ির খামার এবং ৯ হাজার ৬৫১টি বাণিজ্যিক মাছের খামারের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। ছোট ও মাঝারি চিংড়ি চাষিদের ৩০০ টি ক্লাস্টার গঠন করে ই-ট্রেসবিলিটি প্রোগ্রামটি পাইলট করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিত করতে একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর ম্যানুয়াল’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ‘অ্যাকুয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস কন্ট্রোল গাইডলাইন’ দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে আগামীতে মাছ রপ্তানি বাড়বে।