ভরা মৌসুমে ইলিশ গেল কোথায়?
জলবায়ু পরিবর্তন, নদী দখল ও দূষণের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এ মাছ
মেঘনা নদী বেষ্টিত দ্বীপ হাতিয়া উপজেলা। একসময় এই জনপদ ইলিশের সাম্রাজ্য হিসেবে বিখ্যাত ছিল। হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে প্রতিদিন কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়। কিন্তু এখন সে ঘাটে কাঁদছে। আষাঢ়ের শেষেও মাছ মিলছে না। পিক মৌসুমে সরবরাহ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। যে কয়টি ইলিশ আসছে, দাম আকাশ ছোঁয়া। এক কেজি ইলিশের দাম দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা।
ইলিশের এত ক্ষুধা কেন তা নিয়ে বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের রঞ্জিত চন্দ্র দাস ২০ বছর ধরে মেঘনায় মাছ ধরেন। অভিজ্ঞ এই জেলে জানান, এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় নদীতে পানির প্রবাহ কম। তাই সাগর থেকে ইলিশ তার রেঞ্জে পৌঁছাতে পারছে না। চারজনকে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে রঞ্জিত মাছ ধরেন। মার্চ-এপ্রিল দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর ১ মে থেকে তিনি ইলিশ ধরা শুরু করেন। দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইলিশ নেই জানিয়ে রঞ্জিত বলেন, প্রতিবার মাছ ধরতে গেলে নৌকা, তেল, ইঞ্জিন ও সহকারীর খরচ হয় তিন হাজার টাকা। বর্তমানে যে হারে মাছ ধরা হচ্ছে, তাতে তা বিক্রি ও তোলা হচ্ছে না। শুধু নোয়াখালীর হাতিয়া নয়, ইলিশের ‘বাড়ি’ চাঁদপুরের চিত্রও। বরিশাল অঞ্চলেও আশানুরূপ এ মাছ ধরা পড়ছে না বলে জানান স্থানীয় জেলেরা।
তবে ইলিশ বাস্তবে দুষ্প্রাপ্য হলেও সরকারের মতে বছরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫.৬৫ লাখ টন ইলিশ আহরণ হয়েছে, যা ছিল এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫.৫ লাখ টন, ২০১৮-১৯ সালে ৫.৩৩ লাখ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫.১৭ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪.৯৬ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ছয় লাখ টন। মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার উপপ্রধান মাসুদ আরা মমি বলেন, ২০১৫ সালে জুলাই মাস থেকে ইলিশ আসছে। এরপর থেকে প্রতি বছর ইলিশ ধীরে ধীরে আসতে থাকে একটু পর পর। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও হতে পারে। এ বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি হয়নি। জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টি হয়েছে। ইলিশ আসার উপযুক্ত পরিবেশ থাকতে হবে। কয়েক বছর ধরে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সারা বছরের হিসাব করে মোট উৎপাদন নির্ধারণ করা হয়। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টির অভাব, বর্জ্য থেকে পানি দূষণ, নির্বিচারে ছানা নিধন এবং আশ্রয়ের প্রবেশ পথ ভরাটের কারণে ইলিশ হুমকির মুখে পড়েছে। চাঁদপুর রিভার সেন্টারের ইলিশ রিসার্চ স্ট্রেংথেনিং (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পের গত বছরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ইলিশের খাদ্যে শৈবালের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৪২ শতাংশ। পরীক্ষা করে ইলিশের পেটে বালি ও ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর পরিমাণ ৩৬ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন, বেপরোয়া বালু উত্তোলন ছাড়াও নদীর প্রকৃতির পরিবর্তন এবং তৈলাক্ত ও বিষাক্ত পদার্থ পানিতে ফেলার কারণে ইলিশের গঠন ও স্বাদে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। দেশের নদীগুলোর পেটে প্রায় ২৭ শতাংশ অপরিণত ইলিশের ডিম পাওয়া যায়। এমনকি ১৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইলিশ তার পেটে ডিম পাড়ছে। এটাকে অদূর ভবিষ্যতে ইলিশ উৎপাদনের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ইলিশ গবেষণা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. আবুল বাশার বলেন, অল্প বয়সে ইলিশের পেটে ডিম ঢোকার পেছনে তারা প্রাথমিকভাবে দুটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। একটি হল খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন। এই ক্ষেত্রে, তাপমাত্রাও একটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। অন্যটি আন্দোলনের পরিবর্তন (অসম্পূর্ণ স্থানান্তর)। ইলিশের বিচরণ বৃত্ত রয়েছে। তারা নদী থেকে সমুদ্রে যাবে এবং সমুদ্র থেকে নদীতে ফিরে আসবে। নানা কারণে ইলিশ এই বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে পারছে না।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের চলাচলের পথ ও জীবনচক্রে সামান্য প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জুন-জুলাই মাসে বর্ষা মৌসুম হলেও ইলিশ না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখন মৌসুম নয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ইলিশ কম ধরা পড়লে তা উদ্বেগের কারণ। বর্ষাকালকে সাধারণত ইলিশের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তার মানে বৃষ্টি হলেই ইলিশ ধরা পড়বে না। বৃষ্টি শুরু হলে ইলিশের আনাগোনা শুরু হয়। এ সময় নদী ও সাগরের মোহনা দিয়ে তারা প্রজনন ও খাদ্যের জন্য নদীতে আসে। অক্টোবরের পূর্ণিমার সময় বেশিরভাগ ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য সাগর থেকে নদীতে চলে যায়। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে দুটি নতুন চাঁদ এবং পূর্ণিমা হবে। সে সময় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল ওয়াহাব বলেন, সব নদীতে ইলিশ একই সঙ্গে ডিম পাড়ে না। বিভিন্ন নদীতে বিভিন্ন সময়ে ডিম পাড়ে। তাই নদীতে ইলিশ ডিম পাড়লে তা ধরা নিষিদ্ধ করতে হবে।