রাজশাহীতে পদ্মার ভয়াবহতা
পদ্মা নদীকে বলা হয় সর্ব্বনাসা। রাজশাহীর মানুষ প্রতিনিয়ত ধ্বংসের নদীর রূপ দেখছে। এই নদীতে ডুবে যাওয়া মানুষের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। রাজশাহীর পদ্মায় গত ছয় বছরে অন্তত ৫৪টি লাশ ফিরেছে। গত চার বছরে নদীতে পড়ে বা ডুবে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছাত্র। এ সময় পুলিশ অন্তত ১৪টি অজ্ঞাত ও অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। গত ছয় বছরে নৌকাডুবির ঘটনায় আরও ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র সারোয়ার ১০ জুন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শেষে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মায় গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন।
সিয়াম ও রিয়াদ খন্দকার গালিব। রোববার ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল তাদের দুজনের মরদেহ উদ্ধার করে।
এ ঘটনার পর রাজশাহীর পদ্মায় ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঠেকাতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নগরবাসীর দাবি, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিয়াম ও রিয়াদের মৃত্যুর আগে গত ২৬ এপ্রিল কাজলা ফুলতলার কাছে পদ্মা নদীতে ডুবে নগরীর বিনোদপুর কমলা হক ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ফাহিম। ৩ মার্চ লালন শাহ মুক্তমঞ্চ এলাকায় গোসল করতে নেমে ডুবে কিশোর মোহাম্মদ সুহেল, ২৪ ফেব্রুয়ারি চারঘাটে নদীতে ডুবে ১০ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। গত ১৪ মে বাঘার পদ্মা নদীতে নূর ও শিশু লাবনী খাতুন নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়ার ২১ ঘণ্টা পর পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। এর আগে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ এলাকায় পদ্মা নদীতে গোসল করতে নেমে ব্যাংক কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন কাদের রূপম ও তার স্ত্রী মঞ্জুরী তানভীর নিশি মারা যান।
ছয় বছরে নৌকাডুবির মৃত্যু ২১ মার্চ ২০২০ রাজশাহীর ইসলামপুর (শ্রীরামপুর) এলাকায় পদ্মায় নৌকাডুবিতে ৯ জনের মৃত্যু হয়। পদ্মা নদীর ওপারে চরখিদিরপুর এলাকায় রুমনের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে দুটি নৌকায় করে শহরে ফিরছিলেন সবাই। ফেরার পথে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় ৪১ জন নিয়ে নদীতে দুটি নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় বর কনে সহ ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও কনে সুইটিসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর শ্রীপুরে পদ্মা নদীতে খড় বোঝাই নৌকা ডুবে বেগম ও রাশেদা বেগম নামে দুই নারীর মৃত্যু হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর নগরীর মিজানের মোড় এলাকায় পদ্মা নদীতে একটি ডিঙ্গি ডুবে তিনজন নিখোঁজ হন। যাদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এভাবে গত ছয় বছরে নৌকাডুবিতে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
৪ বছরে পদ্মা নদী থেকে ১৪টি লাশ উদ্ধার
গত চার বছরে রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে অন্তত ১৪টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। যার অধিকাংশই ছিল অজ্ঞাত ও অর্ধগলিত। ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর নগরীর পাঠানপাড়া লালন শাহ মুক্তমঞ্চ এলাকায় পদ্মা নদী থেকে এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। একই বছরের ২ সেপ্টেম্বর নগরীর কাজলা শিপইয়ার্ড ও বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক এলাকা সংলগ্ন পদ্মা নদী থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১ এপ্রিল পাঠানপাড়া মুক্তমঞ্চ এলাকায় পদ্মা নদীতে এক যুবকের লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। গত ৪ এপ্রিল বড়কুঠি এলাকার পদ্মা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয় আরেক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ।
শ্রীরামপুরে মৃতের সংখ্যা বেশি
গত তিন বছরে শ্রীরামপুর শহরের পদ্মা নদীতে ডুবে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। পৃথক পাঁচটি ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে নৌকাডুবিতে ১১ জন এবং গোসল করতে গিয়ে মারা গেছেন। গত শনিবার ওই দুই কলেজ ছাত্র মারা যান। এর আগে ২০২২ সালে বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা এরফান আলী মারা যান। নৌকাডুবিতে সোনাইকান্দি দামকুড়ার সুমন আলীর স্ত্রী আছিয়া বেগম ও একই এলাকার আলম হোসেনের স্ত্রী রাশেদা বেগম মারা যান।
রাজশাহী শহরে কোনো পর্যটন কেন্দ্র নেই। ফলে এ শহরের বাসিন্দাদের বিনোদনের প্রধান কেন্দ্র পদ্মপদ। প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার মানুষ নদী তীরে বেড়াতে আসেন। বেড়াতে আসা অনেকেই পদ্মায় গোসল করেন। তারা প্রায়ই স্রোতে ডুবে মারা যায়। তাই তাদের নিরাপত্তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সচেতন নাগরিকদের।
রাজশাহীর সমাজ বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, এ মৃত্যুর জন্য সিটি করপোরেশন, প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড দায়ী। এই তিনটি সংস্থাই দায়িত্ব নিতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে পারে। শহরে সাঁতারের পাঠ নেই। ফলে আজকের শিশুরা সাঁতার জানে না।
রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ জানান, শহরের আশপাশে পদ্মা নদীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে পদ্মায় যারা ডুবে গেছে তাদের অধিকাংশই ছাত্র।