খরতাপে বিশাল ঝুঁকিতে পাহাড়।ভয়াবহ ভূমিধসের ছয় বছর আজ
- ক্রমাগত বৃষ্টির সময় ভূমিধস আবার বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে কারণ মাটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়
- চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় হাজার হাজার মানুষ বিপদের মধ্যে বসবাস করছে
- কাগজে সুপারিশ আছে বাস্তবে নয়
- তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি মাটি অম্লীয়। এই ধরণের মাটির উপরের অংশটি পাতলা, নীচের অংশে নুড়ি বা ছোট পাথর এবং বালি থাকে। বালি ও দোআঁশ শ্রেণীর এই মাটি সাধারণত নরম হয়। এই মাটি এখন স্মৃতির খরায় কুঁকড়ে গেছে। ভারী বর্ষণ উপরের মাটি ধুয়ে ফেলতে পারে এবং বড় ধরনের ভূমিধসের কারণ হতে পারে। বর্ষাকালে চট্টগ্রামের কয়েকটি পাহাড় ও তিন পার্বত্য জেলায় এ ধরনের ভূমিধসের কারণে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
- তিন পার্বত্য জেলার পাদদেশে প্রায় ২১৫,০০০ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। চট্টগ্রামের ১৮টি পাহাড়ে এমন অর্ধ লাখ বিপজ্জনক জনবসতি রয়েছে। উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নিম্নচাপের প্রভাবে পাহাড়ে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণও হচ্ছে। ভারী বর্ষণে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়বে।
১৩ জুন, ২০১৭, টানা ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য জেলা এবং কক্সবাজারে ১৬৮ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। ভেদভেদী যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, রূপনগর, সাপছড়ি, মগবান, বালুখালী এলাকায় এবং জুরাছড়ি, কাপ্তাই, কাউখালী ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ভয়াবহ দুর্যোগে পাঁচ সেনাসদস্যসহ ১২০ জন নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। রাঙামাটিতে ১,৬০০ থেকে ১,৭০০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারাদেশের সঙ্গে এক সপ্তাহের জন্য সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এই ভয়াবহ ভূমিধসের পর পুনর্বাসন তো দূরের কথা, পাহাড়ের ভাঁজে তৈরি হয়েছে আরও নতুন ঘর।
- চট্টগ্রামে পাহাড় কাটছে সরকারি প্রতিষ্ঠান
চট্টগ্রামে ব্যক্তি ছাড়াও সরকারি প্রতিষ্ঠানও নির্বিচারে পাহাড় কাটছে। পাহাড় কাটার অভিযোগে সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। তাদের একজন জহিরুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার একাধিক মামলা রয়েছে। লালখানবাজার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এএফ কবির মানিক ও পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরনের বিরুদ্ধেও পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। বায়েজিদ বোস্তামী লিংক রোড নির্মাণে ১৩টি পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এ জন্য তাদের ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ওয়াসার বিরুদ্ধেও পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে।
সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও পাহাড় কাটছেন। গত বছর নগরীর বায়েজিদের আরেফিননগর এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলে পাহাড় কাটার প্রমাণ পান। পাহাড় কেটে সেখানে ঘরবাড়ি, পানির কূপ, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তা’লীমুল কুরআন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ তৈয়্যবের নির্দেশে পাহাড় কাটার প্রমাণ পায় পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু পাহাড় কাটার কোনো অনুমতি ছিল না। আসামিদের শুনানির নোটিশ দেওয়া হয়। তারা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সম্প্রতি পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের ২৯টি স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া নানিয়ারচর, কাউখালীসহ কয়েকটি উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ১৫ হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করছে। বান্দরবানের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে দুই হাজারের বেশি পরিবার। খাগড়াছড়ির চার হাজারের বেশি পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ে নির্বিচারে বসতি স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বন ও গাছপালা ধ্বংসের কারণে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস হচ্ছে। ২০১৭ সালে ভয়াবহ ভূমিধসের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কমিটি বিভিন্ন সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী বিক্ষিপ্ত জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী আবাসন বরাদ্দ, রাঙামাটিতে গৃহহীন ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের জন্য সরকারি অর্থায়নে বহুতল ভবন নির্মাণ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘর নির্মাণ বন্ধ করা। , পাহাড়ে পরিবেশবান্ধব ও পাহাড়ি রক্ষাকারী গাছ ও বাঁশ রোপণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। আশ্রয়ণ প্রকল্প, পাহাড় থেকে মাটি কাটা ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ইত্যাদি সুপারিশ কাগজে কলমে থাকলেও সেগুলো এখনো দৃশ্যমানভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তবে প্রতি বছর বর্ষা এলেই জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাইনবোর্ড ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে।