ঢাকায় মালয়েশিয়ার ভিসার ব্যবসা।দূতাবাসের চালকের পকেটে ১০ কোটি টাকা
জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকায় মালয়েশিয়া দূতাবাসের ভিসা শাখার একজন জুনিয়র। কখনো গাড়ি চালান, কখনো অফিসে চা-কফি বানালেন। দূতাবাসের আরেক অফিস সহকারী কবির হোসেন। দুজনেই কুমিল্লায় থাকেন। তবে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে ভিসা বাণিজ্যে জড়িত। কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় একটি মামলার তদন্তকালে মালয়েশিয়ার এই ভিসা বাণিজ্য সিন্ডিকেটের নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে।
গত ৫ এপ্রিল কুমিল্লার দুর্গাপুরের ঘোড়ামারা এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর হোসেনকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। তার কাছ থেকে ১ কোটি ১৩ লাখ ১০০ টাকা, সাতটি পাসপোর্ট ও ৫ হাজার ১০০ ডলার জব্দ করা হয়। গত ২৯ এপ্রিল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে তুরস্কে পালিয়ে যাওয়ার সময় কবিরকে আটক করা হয়। পরে তাকে কুমিল্লা জেলা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুজনই ভিসা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
তদন্তে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের টাকা ভিসা ব্যবসার জন্য। তিনি দেশের টাকা পাচার করেছেন। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর বলেন, ভিসা ব্যবসায় তিনি প্রায় ১০ কোটি টাকা আয় করেছেন। কিন্তু এই টাকার একটা অংশ তার আরেক বন্ধুর কাছে আছে। জাহাঙ্গীরের বন্ধুর বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের কাছে জাহাঙ্গীর স্বীকার করলেও প্রায় ১০ কোটি টাকা আয় করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে কবির যাতে বিদেশে পালাতে না পারে সেজন্য দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। মালয়েশিয়া দূতাবাসও অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর রাখতে বলেছে। কবীর ব্যবসা ভিসায় বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাহাঙ্গীর তার জবানবন্দিতে কবির হোসেনের সম্পৃক্ততার কথা বলেন। পরে কবিরকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ভিসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। এজেন্সির সঙ্গে ভিসা বিভাগের লোকজন সমন্বয় করতেন কবির। ২০১২ সাল থেকে তিনি মালয়েশিয়া দূতাবাসে কর্মরত আছেন।
কবির ও জাহাঙ্গীর জানায়, ট্রাভেল ভিসায় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর আড়ালে তারা ব্যবসা করত। প্রতি ভিসা থেকে ৫-১০ হাজার টাকা নিতেন। তবে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা বলছেন, ট্যুরিস্ট ভিসা ছাড়াও তারা আরও ভিসা জালিয়াতি করছিলেন।
পুলিশ জানায়, গত ৬ এপ্রিল জাহাঙ্গীরের বাড়িতে অভিযানে স্টিলের ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ১ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ১০০ টাকা ও ৫ হাজার ১০০ ডলার পাওয়া যায়। গ্রেফতার এড়াতে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। এ চক্রে তার সহযোগী হিসেবে ফয়েজ মিয়া, মো. আবুল হাসেম ও বাবুল মীরও আছেন। বাবুল মীরের কাজ ছিল মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পাসপোর্ট সংগ্রহ করে জাহাঙ্গীরের কাছে হস্তান্তর করা।
এদিকে কবিরের দেশি-বিদেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য খুঁজছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। তার বাবা আব্দুল গণি বিদ্যুৎ বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। কুমিল্লার একটি গ্রামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ডুপ্লেক্স বাড়ির তদন্ত শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেনামে জমিও কিনেছেন। ঢাকায় ফ্ল্যাট, চাঁদপুরের বাজার, হ্যারিয়ারসহ দুটি গাড়ি, হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠানোসহ আরও কয়েকটি অভিযোগের বিষয়েও বিস্তারিত তদন্ত শুরু হয়েছে। গোয়েন্দারা একটি ছোট কর্মচারীর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পিছনের গল্পটি খুঁজে বের করার জন্য ঝাঁকুনি দিচ্ছেন। জরুরি ভিসা পাওয়ার বিনিময়ে ব্যবসা করতেন। ভিসা শাখায় তার শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল মান্নান বলেন, ভিসা বাণিজ্যের এই চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত রয়েছে তাদের শনাক্ত করা হবে। কবিরকে আজ দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হবে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কবির দাবি করেন, তিনি তুরস্কে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে কেন তিনি বেড়াতে গেলে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) বলেন, মালয়েশিয়ায় ১০০টি অনুমোদিত সংস্থা কর্মী পাঠাচ্ছে। কিন্তু তাদের লাইসেন্স নিয়ে আরও অনেকে কাজ করছেন। একজন কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে এখন খরচ হয় সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। কিন্তু একটি গ্যাং আছে, যারা ট্যুরিস্ট ভিসা দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠায়। পুলিশ এখন যে দূতাবাসের রিংটি তদন্ত করছে তা মূলত প্রতারণামূলক ভ্রমণ ভিসায় জড়িত ছিল। ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে মালয়েশিয়া সরকার ইতিমধ্যেই ঢাকা দূতাবাস থেকে তাদের দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে।
জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি জানান, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ১০০ জনের একটি সিন্ডিকেট। কারখানা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিক এই তিন ক্যাটাগরিতে শ্রমিক পাঠানো হয় দেশে।