মানব পাচারের নতুন গন্তব্য।কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিরা ভুয়া কোম্পানির ফাঁদে
ইসমাইল হোসেন মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করেছেন। শিবালয়ের মহাদেবপুরে তার কৃষক বাবা আবুল কালামের পাঁচ সদস্যের পরিবার। কম্বোডিয়ায় দেশত্যাগ করে, ইসমাইল বিশ্বের সমৃদ্ধি আনতে একটি রঙিন স্বপ্ন বুনেন। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি পড়াশোনার জন্য টাকা ধার নিয়ে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর কম্বোডিয়ায় যান। দুই মাসও পার হয়নি। তিক্ত অভিজ্ঞতার দুঃস্বপ্ন দেখে ১১ নভেম্বর দেশে ফিরে আসেন টেটো।
ইসমাইল জানালেন তার জীবনের কষ্টের গল্প। তিনি বলেন, কম্পিউটার অপারেটর পদে মাসে ৭৫ হাজার টাকা। ‘জেকে এক্সিলেন্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে এমন ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়েছিলেন বাংলাদেশের দালাল মুকুল। কম্বোডিয়ায় অবতরণের পরপরই রাজধানী নমপেনের একটি হোটেলে এটি তোলা হয়। সেখানে তানভীর নামে কম্বোডিয়ার আরেক দালাল তার পাসপোর্ট নিয়ে যায়। দুদিন পর তাকে অন্য হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। পাসপোর্ট না দেখানোয় তাকে গ্রেফতার করা হয়। যেখানে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিল এক ধরনের কারাগার। কেউ কেউ একে ‘নিরাপদ বাড়ি’ বলে থাকেন। ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হয়ে ১১ নভেম্বর দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই জীবন বাঁচানোর লড়াই ছিল। একটি পোশাক ৪৪ দিন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রাখা হয়। একই ফুল প্যান্ট ও জার্সি অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। খাবার দেওয়া হয়নি ঠিকমতো। লোকজনের মাধ্যমে বাড়ির খবর দেওয়া হয়।
ইসমাইলের মতো অনেকেই স্বপ্ন নিয়ে কম্বোডিয়ায় গিয়ে যন্ত্রণা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। বাংলাদেশ থেকে যারা উন্নত কর্মসংস্থানের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায় তাদের ৫১ শতাংশই পাচারের কবলে পড়ে। গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক আলোচনায় এ তথ্য উঠে আসে, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পাচারের দেশ। বৈধ ও অবৈধ পথে ভারত, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, ইরাক ও লিবিয়া যাওয়ার কথা বলা হয়। সেখানে কম্বোডিয়ার নাম ছিল না। দেশ এখন মানব পাচারের নতুন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই প্রতারিত হয়ে এশিয়ার ‘ইউরোপ’ হিসেবে পরিচিত দেশ থেকে বাংলাদেশিরা ফিরছেন। কম্বোডিয়া থেকে ফিরে আসা দুই হতভাগ্য ব্যক্তি ঢাকায় এসে পৃথক দুটি মামলা করেছেন। এর মধ্যে একটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। আরেকটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
দেশে যারা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আমিনুল খন্দকার তাদের একজন, এমন অনেক ভুক্তভোগী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নমপেনে তার বিশাল অফিস আছে। তার দুই সহযোগী শামীম আবদুল্লাহ ও আবু তাহের। বাংলাদেশ-ভারত থেকে তাদের মাধ্যমে কেউ কম্বোডিয়া গেলে বিমানবন্দরে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। আমিনুল মানব পাচারের পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সে নমপেন থেকে একটি ভুয়া কোম্পানির নামে কাজের আদেশ পাঠায়। এ ছাড়া কম্বোডিয়াতেও একই ধরনের প্রতারণা করছে সংস্থাটি। জালাল, নাজমুল, আব্দুল আলিম, শফিক আহমেদ, সেলিম রেজা, আলী রেজা ও লায়ন কামাল। আর কম্বোডিয়াভিত্তিক গ্যাংয়ের হয়ে বাংলাদেশে যারা কাজ করছে তারা হলেন- নাজিরপুরের মাসুদ খান, মাহমুদ খান, বরিশালের জিএম ফেরদৌস, জিয়াউর রহমান, চাঁদপুরের মতলবের জাহাঙ্গীর আলম।
কম্বোডিয়ায় প্রতারণা সংক্রান্ত একটি মামলার তদারকি করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কম্বোডিয়ায় যাওয়া বেশিরভাগ বাংলাদেশি প্রতারিত হচ্ছেন। নামী কোম্পানিতে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেগুলো চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। ইন্টারপোল এবং এনসিবি কম্বোডিয়ায় থাকা কিছু লোকের খোঁজ করছে। নমপেনে গ্যাংয়ের হয়ে ঢাকায় কর্মরত সোহেল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কম্বোডিয়ায় লোক পাঠানোর জন্য সোহেল প্রতি লাখে ২৫ হাজার টাকা পেতেন।
৪৪ দিনের কারাদণ্ড: প্রতারক ইসমাইল বলেন, ‘গ্রেফতারের পর ৪৪ দিনের কারাদণ্ডের প্রতিটি মুহূর্ত যে কঠিন ছিল, তা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। ভেবেছিলাম এখন মরে যাব। ২ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে কম্বোডিয়া গিয়েছিলাম। পরে সেখানে পৌঁছে পর্যায়ক্রমে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে আসি। সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছে ৬ লাখ টাকা। পাসপোর্ট উদ্ধারের জন্য দালালকে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘একজন অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে আমি নমপেনে মাত্র চার দিনের জন্য মুক্ত ছিলাম। কোনো কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাইনি। আমি কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে, আমাকে একটি চীনা কোম্পানির কাছে ৫,০০০ ডলারে বিক্রি করা হয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলাম। এখন কিভাবে ছয় লাখ টাকার ঋণের বোঝা মেটাবেন তা নিয়ে চিন্তায় পরিবারটি। জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরলেও ঠিকমতো ঘুম হয় না।’