ভূমিকম্প সহনশীল ঢাকা গড়তে প্রস্তুতি কতদূর?
ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে হতবাক গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশের মানুষও হতবাক ও ভীত। ভূমিকম্প মানুষের মনে নতুন উদ্বেগে ভর করেছে। তুরস্কে ভূমিকম্পের তিন দিন আগে, একজন ডাচ গবেষক টুইটারে পূর্বাভাসটি শেয়ার করেছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখা দিয়েছে।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস গবেষণায় বাংলাদেশ কী করছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ১০০ থেকে ১২০ বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে ঠিক কবে কোথায় এই ভূমিকম্প হবে তা বলা যাচ্ছে না। ডাচ গবেষকও নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় দিতে পারেননি। সম্প্রতি বা পরে তুরস্কে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি। তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। এটা একটা কাকতালীয়। উন্নত দেশগুলো এ নিয়ে গবেষণা করছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের ১৫ সেকেন্ড আগে পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি তৈরি হলেও তা পুরোপুরি সঠিক নয়। তবে এসব গবেষণায় বাংলাদেশও জড়িত বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে সঠিক তারিখ না জানালেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ভূমিকম্পের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, সঠিক তারিখ ও সময় বলা না গেলেও বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। এটি ৫ থেকে ১০ বছর বা তার পরেও হতে পারে। সে অনুযায়ী আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকায় চার লাখ আবাসিক ভবন ও সাড়ে তিন হাজার কারখানা ভবন রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার কারখানা ভবন এবং ২৫ শতাংশ আবাসিক ভবনের নির্মাণ ত্রুটি পাওয়া গেছে। একটি বিল্ডিংকে ভূমিকম্প প্রতিরোধী করতে প্রতি বর্গফুট ২৫ থেকে ৩০ টাকা খরচ হয়। আর যদি নির্মাণের পর ভবনটিকে ভূমিকম্প প্রতিরোধী করতে হয়, তাহলে প্রতি বর্গফুট খরচ হবে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। সেই তথ্য সবার সামনে তুলে ধরলে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। এরপর আইন প্রয়োগের প্রয়োজন।
নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রতি মাসে ৪৫ হাজার ভবনের নকশা অনুমোদন করে। এর মধ্যে পেশাদার স্থপতিদের দ্বারা ডিজাইন করা এক হাজার ভবন, বাকিগুলো ভুয়া। একটি বিল্ডিং এর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ তার নিচতলা হওয়া উচিত। তবে দেশের অধিকাংশ ভবনের নিচতলা কয়েকটি পিলার দিয়ে তৈরি। ঢাকার সম্প্রসারিত বা নতুন আবাসিক এলাকার মাটি নরম ও দুর্বল। এ ধরনের মাটিতে ইমারত নির্মাণ নিয়ম না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে মাঝারি মাত্রার কম্পন হলেও ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
ঝুঁকি বেশি, প্রস্তুতি কম
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই ভূগর্ভস্থ গ্যাস লাইন নেই। তুরস্ক ও সিরিয়ার সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য রয়েছে। ঢাকা শহরে গ্যাস এক্সটেনশন লাইনগুলো কেমন আছে তার কোনো তদারকি নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় খোঁড়াখুঁড়ি হওয়ায় সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে গ্যাসের লাইনে বড় জাল। বড় ভূমিকম্প হলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো গ্যাস নির্গত হবে। গ্যাস রিলিজ এবং বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট একত্রিত হলে বিস্ফোরণে পুরো শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। আগুন ভূমিকম্প প্রতিরোধী হলেও একটি ভবনকে বাঁচাতে পারবে না। কারণ পুরো শহর আগুনে পুড়ে যাবে। ঢাকার মানুষ টাইম বোমায় বসে আছে উল্লেখ করে স্থপতি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর গ্যাস সঞ্চালন লাইনে সার্কিট ব্রেকার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত এখন ফাইলে রয়েছে। অথচ খুব একটা খরচ হতো না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৫ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছয়টি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। রিখটার স্কেলে তাদের মাত্রা ছিল ৭ থেকে ৮.৭। প্রতি ১০০ থেকে ২০০ বছরে এই ধরনের ভূমিকম্প হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন এবং ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ জিল্লুর রহমান বলেন, অতীতে বাংলাদেশ ও এর আশপাশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। তবে কবে হবে তা বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের মহাপরিচালক আজিজুর রহমান বলেছেন, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে যে গবেষণা চলছে, তার সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ। গবেষণা থেকে কোনো ফলাফল এলে বাংলাদেশ তার সুবিধা ও সেবা নিতে পারে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এলাকাভিত্তিক গ্যাস লাইনে অটো শাটডাউন সিস্টেম বসানোর কথা বলে আসছি।বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মো. এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন।এর পর আর কোনো অগ্রগতি নেই।