ঋণের টাকার রাজনীতি, শেষ পর্যন্ত ভরাডুবি

0

ব্যাংক ঋণের অন্যায় ব্যবহারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রামের অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। কেউ কেউ রাজনীতির প্রেমে পড়ে ঋণের টাকা উড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ ঋণ নিয়ে রাতারাতি ব্যবসা বাড়াতে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। লোভের কারণে তারা শেষ পর্যন্ত পারিবারিক ব্যবসায়িক ঐতিহ্য ও রাজনীতিতে সম্মান হারিয়ে ফেলে। আলোচিত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা কারাগারে আছেন বা মামলা মাথায় রেখে অনেকে পলাতক রয়েছেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের এড়াতে, তারা এমনকি খুব কাছের মানুষ ছাড়া কারও কাছ থেকে কল গ্রহণ করে না। কারাগারের বাইরে যারা আছেন তারা নিজের অফিসেও বসেন না।

খাতুনগঞ্জের সাবেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্স। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা রাজনীতিতে খরচ করে প্রতিষ্ঠানের মালিকরা তাদের সুনাম ধরে রাখতে পারেননি। রাইজিং গ্রুপের আসলাম চৌধুরীও রাজনীতিতে ঋণের টাকা ঢেলে ‘নিঃস্ব’ হয়েছেন। হঠাৎ করেই এমপি হওয়ার ইচ্ছায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে জানা গেছে। এখন তিনি কারাগারে। আবারো রাজনীতিতে জড়িয়ে ব্যাংক ঋণের জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য মাহজাবীন মোরশেদ। মামলায় তার স্বামী মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমকেও আসামি করা হয়েছে। তবে মোর্শেদ ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি।

শামসুল আলম রাজনীতিতে এসে বেনেদী প্রতিষ্ঠানকে ডুবিয়ে দেন: দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভাইয়ের সঙ্গে ‘ইলিয়াস ব্রাদার্স’ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ইলিয়াস। ব্যবসাটি ভোগ্যপণ্য দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে জিপি-সিআই শিট, গ্লাস শিট, সয়াবিন তেল, কাগজ ও বোর্ড, তৈরি পোশাক এবং ইটভাটার ব্যবসায় বিস্তৃত হয়। তাদের ‘দাদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল এবং মিনারেল ওয়াটার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু ইলিয়াসের সেই কৃতিত্ব ধরে রাখতে পারেননি তার ছেলে নুরুল আবছার ও শামসুল আলম। ব্যবসা ছেড়ে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন শামসুল আলম। প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিএনপির আমলে দুই হাত ভরে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে শুরু করেন। সেই ঋণের টাকা তারা রাজনীতিতে খরচ করেছেন বলে অনেকে জানান। তিনি ভেবেছিলেন এমপি হয়ে ব্যাংককে বশ করতে পারবেন। কিন্তু শামসুল আলমের সে আশা পূরণ হয়নি। এখন তিনি কারাগারে। তাদের পারিবারিক ব্যবসাও ভেঙে পড়েছে। শিল্প গ্রুপ ইলিয়াস ব্রাদার্স এখন দেশের শীর্ষ ২০ খেলাপিদের মধ্যে একটি। বিভিন্ন ব্যাংকে গ্রুপটির খেলাপি ঋণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮৩ কোটি টাকা খেলাপির দায়ে শামসুল আলমসহ গ্রুপের পাঁচ পরিচালককে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। আবার সাউথইস্ট ব্যাংকের ৮৫ কোটি ৫৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা খেলাপি হওয়ায় পাঁচ পরিচালককে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আলম, চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আলম, শামসুল আলমের স্ত্রী ও পরিচালক কামরুন নাহার বেগম, নুরুল আবসারের স্ত্রী ও পরিচালক তাহমিনা বেগম। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ আদালতে অর্ধশতাধিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকে ২৮০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৭৩, ইসলামী ব্যাংকে ৬৩, এবি ব্যাংকে ৬২, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫৫, সিটি ব্যাংকে ৫৫, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৯, ওয়ান ব্যাংকে ৩০ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ২৪, শাহজালালে ১৮ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকে ৭ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি ঋণ চার কোটি টাকা।

রাজনীতিতে ঋণের টাকা ঢেলে কারাগারে আসলাম চৌধুরী : বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আসলাম চৌধুরী। এক পর্যায়ে কবির শিক্ষকতা ছেড়ে স্টিল মিল কোম্পানিতে যোগ দেন। এছাড়াও কনফিডেন্স সিমেন্ট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে কনফিডেন্স সল্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যবসাই তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও বিএনপির আমলে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০২ সালে, তিনি জিয়া পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক হন। আসলাম চৌধুরীর হাত ধরে ঋণের সংসারে এই পদের প্রভাব। রাতারাতি ব্যাংকের টাকায় গড়ে উঠেছে রাইজিং গ্রুপ। গড়েছেন এক ডজন শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তিনি তার সম্পদের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ঋণ নিয়েছেন। তিনি এখন ৮০টির বেশি মামলার আসামি। তিনি সাত বছর ধরে কারাগারে আছেন।

আসলাম চৌধুরী ২০০৭ সালে সরাসরি বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। সংগঠনের প্রয়োজনে অর্থ ঢালতে থাকেন। অনেক নেতাকে পেছনে ফেলে তিনি উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সীতাকুণ্ড আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পান। তবে আওয়ামী লীগের আবুল কাসেম মাস্টারের কাছে হেরে যান তিনি। পরে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক পদে জয়ী হন জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। এরপর তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হন। মোসাদ (ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা) মামলায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। পরিবারকেও দুদকের মামলায় আসামি করা হয়েছে। এবি ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় বিচার চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *